পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২ মে, ২০১৮

পাত্রী চাই (সত্যি গল্প)

সোহেলী জান্নাত

পাত্রী চাই (১):

#গল্প
(ঘটনাটি অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু সাইবার ক্রাইম আইনে মানহানির মামলায় ফেঁসে যেতে পারি ভেবে গল্প নামে চালিয়ে দিচ্ছি! নইলে গল্প লেখার দু:সাহস আমার নেই!)

ক্লাসমেট বন্ধু আমার সদ্য বিসিএস পাশ করে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জয়েন করেছে।আমাকে ফোন করে জানায় নি।ফেসবুকে নিজের পরিচয়ের জায়গায় যখন গোটা গোটা হরফে লিখে দিয়েছে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অফ.....!  তখনই জানতে পেরেছি। খুব খুশিও হয়েছি, আবার অবাকও! ব্যাকবেঞ্চার ক্যাবলাকান্ত কিছুটা মিনমিনে বন্ধু আমার কী করে এই অসাধ্য সাধন করলো!
যাইহোক! করেছেতো! মিনমিনে বলায় আবার কেউ রাগ করবেন  না।  একটি ঘটনার প্রেক্ষিতেই বলেছি।সে ঘটনা পরে একদিন বলা যাবে। মূল কথায় আসি।

তো হটাতই একদিন বন্ধুর ফোন পেলাম।
:দোস্ত কেমন আছিস!
শিহাব বলছি।( ছদ্মনাম)
খুব সাবলীল ভঙ্গী।আমাকে তুই করে বলায় অবাক হলাম কিছুটা! পুরো ভার্সিটি লাইফে আমিতো দূরের কথা অন্যকোনো মেয়েকে তুই বলার মত আত্মবিশ্বাসী ছেলে সে নয়! বুঝলাম একটা  চাকুরি অনেক কিছু পরিবর্তন করে দিয়েছে।

 তার দৌড় ছিল ক্লাসের পিছনে বসে মেয়েদের ওড়না পড়ার ঢং বিশ্লেষণ করে ক্লাসটাইম পার করায়!  মেয়েরাও তাকে পাত্তা দিত না খুব। কিন্তু এখন দেয়।শিহাবের একটা লুতুপুতু হাবিজাবি স্টাটাসে শতাধিক কমেন্ট পড়ে।লাইকের সুনামি ঘটে যায়! এবং বলা বাহুল্য অধিকাংশই মেয়ে। শিহাব এখন কাঙ্খিত পাত্র! ওর ঘোর কালো পাথুরে রঙ এখন ড্যাশিং কালার! এমন হাড্ডিমাস ফিগার মেধাবীদের হয়েই থাকে! এ আর এমন কী!

অত:পর, আমিও হাসি মুখে প্রতিউত্তর করলাম
:কী খবর! কেমন আছ? নতুন জব! কেমন লাগছে! মিস্টি খাওয়ালেনা কিন্তু!
: দোস্তো আগে বিয়েটা দিয়ে দাও এবার! একবারেই মিস্টি খাওয়াই!( আমার তুমি শুনে শিহাবো আগের রূপে ফিরে গেছে।তুমি করেই বলছে!)
: বিয়ে করতে চাও? ভালোতো! তা তোমার আবার মেয়ের অভাব নাকি! ফেসবুকে দেখলাম লাইন লেগে গেছে!
:না দোস্ত! যেন তেন মেয়েকি আর বিয়ে করা যায়! একটা ভালো মেয়ে খুঁজে দাও।তুমি ইউনিভার্সিটিতে আছ দেখে তোমাকেই বলছি।
: আচ্ছা! তা কেমন মেয়ে চাও?
: দোস্তো তোমার মতো মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী,  স্বাবলম্বী! প্রথম শ্রেনীর চাকুরী করা হলে ভাল হয়! সংসারে সাপোর্ট পাবো।
 তুমিতো আগেই বিয়ে করে ফেলেছো, নইলে ইউনিভার্সিটিতে তুমি কিন্তু আমার ক্রাশ ছিলে! ভয়ে সাহস করে বলতে পারি নি!
এই কথা শুনে শিহাবের প্রতি যে নেগেটিভ ধারণা ছিলো সেটি নিমিষেই পালটে গেলো! নাহ! ছেলেটাতো ভালোই! মেয়েদের দেহ নয়, মেধার মুল্যায়ণ করছে!( বলতে লজ্জা পাচ্ছি, তবু বলি, শিহাবের উপযুক্ত প্রশংসা এবং আমি ক্রাশ ছিলাম যেনে কিঞ্চিত খুশিও হয়েছি।)

তবু ক্লিয়ার হবার জন্য আবারো জিজ্ঞাসা করলাম :সুন্দরী চাও না? মেয়ের বাপের টাকা পয়সা চাও না?

: নাহ দোস্ত।  সুন্দর মোটামুটি হলেই হবে।বেশি সুন্দরে ঝামেলা! গাছের পাঁকা বড়ইয়েই ঢিল পরে বেশি!
আর বাপের টাকা দিয়ে আমার কী হবে! আমি দিন মজুরের ছেলে! বড়লোকের দুলালী হলে শেষে আমাকেই খোঁটা দেবে।আব্বা মাকে সম্মান করবে না।ভাইবোনদের ভালবাসবে না।

একটানে বলে গেলো কথাগুলো! ওর এই মনোভাব খুব ভালো লাগলো আমার। বাহ! ছেলেটা পরিবারের কথা কি সুন্দর করে ভাবছে!
ওকে বললাম:
: ঠিক আছে বন্ধু, তোমার জন্য মেয়ে আমি দেখবো।



কিছুদিন পর অনেক ভেবেচিন্তে আমার বিভাগে টিচার হিসেবে জয়েন করা এক জুনিয়র কলিগের ছবি ও সিভি শিহাবকে ইনবক্স করলাম। মনে আশা ছিল শিহাব যেমন মেয়ে চাইছে এ ঠিক তার সাথে মানিয়ে যাবে। নামকরা পাব্লিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মেয়ে। মফস্বল শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবার।দেখতে প্রেজেন্টাবল। আর কী চাই! শিহাব নিশ্চিত পছন্দ করবে। জুনিয়র কলিগকেও শিহাবের কথা বলে বলে ভালোই পটিয়ে ফেলেছি। ( ঘটকালি আমার ভালোই লাগে।) সেও এখন শিহাবের নাম  শুনলে লজ্জা পেতে শুরু করেছে!

আর আমিতো শিহাবকে ছবি সিভি ইনবক্স করেই ওদের বিয়েতে কী শাড়ি পরবো সে নিয়ে মধুর কল্পনা শুরু করে দিয়েছি।কিন্তু সব আশা উৎসাহে একমুঠো ছাই ডলে দিয়ে শিহাবের ফিরতি ইনবক্স আসলো মেয়ে পছন্দ হয় নি!

:একটু বয়স বেশি হয়ে যায়! অল্পতে বুড়ো হয়ে যাবে!
চেহারাটা ঠিকি আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিউটনেস স্লাইট কম!
দোস্তো মনে কিছু নিওনা আর একটু দেখো!

বলাবাহুল্য আমি আশাহত হয়েছি, রাগো হয়েছি।তবু ওকে বোঝানোর চেস্টা করলাম  : তুমি একদিকে চাকুরিজীবী মেয়ে চাইছো, আবার বলছো বয়স বেশি! বাংলাদেশে কত কম বয়সে চাকুরী সম্ভব?
মিনমিনে শিহাব মিনমিন করলো
:দোস্তো মেয়েটার বোধ হয় একটু ভুড়ি আছে!

এমন রাগ হলো আমার। লাস্ট লাইন দেখে মাথায় আগুন ধরে গেলো! তীব্র ইচ্ছা হলো  একটা কুৎসিত গালি দেই। কিন্তু লগ আউট করে ম্যাসেঞ্জার থেকেই বেরিয়ে আসলাম!
এখন ভাবছি আমার কলিগকে না করি কী করে!


পাত্রী চাই (২)

জুনিয়র কলিগকে এই বলবো সেই বলবো করে করে নানান প্লান আঁটলাম!  কিন্তু শেষমেশ কিছুই বলতে পারলাম না! আমাকে নীরব দেখে সেই লজ্জার খোলস ছেড়ে প্রকাশ্য হলো:
: কী ব্যাপার আপু! আপনি দেখি আর কিছুই বলেন না! আমাকে কি বাতিল করে দিয়েছে নাকি আপনার পাত্র? হা হা

হেসে প্রসংগটা হালকা করার চেস্টা করলেও বুঝলাম বেচারী মনে আঘাত পেয়েছে। ওর এই বিমর্ষ মুখশ্রী দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো,সেই সঙ্গে মনে পড়লো শিহাবের ভুড়ি বিষয়ক মন্তব্য! ভাবলাম একটা প্রতিশোধ নিয়ে আত্মা শান্ত করি।

আমিও হেসে বললাম, উঁহু  তোমাকে বাতিল করার মত মাথা কয়টা ছেলের আছে! আরে আমিই ওকে আর যোগ্য মনে করছিনা তোমার! রিসেন্ট শুনতে পেলাম ছেলেটা নাকি টি এস সির সুইমিং পুলে বসে গাঁজা খেতো ছাত্রাবস্থায়! মন্দ চরিত্রের পোংটা টাইপ! (বলা বাহুল্য  গাঁজাতো দূরের কথা, সামান্য গোপাল বিড়ি  ছুঁয়ে দেখার মতো সাহসও শিহাবের ছিলোনা তখন, সবি বানানো!)

: হায় হায় কী বলেন আপু! এ ছেলে মাদক বিরোধী অভিযানে নেমে নিজেইতো সব সাবাড় করে দেবে! নেশা সহজে কি কেউ ছাড়তে পারে! মাগো! বড় বাঁচা বেঁচে গেছি! আর  আপু আপ্নিও নাহ! না জেনে শুনে কত ভাল ভাল কথা বললেন এতদিন!

যাক! সেবারকার মতো সে প্রসঙ্গ ক্ষতম হলো।

কিছুদিন পর শিহাব আবারো নক করতে শুরু করে দিয়েছে।দোস্তো রাগ করেছ? প্লিজ.... একটা ভাল মেয়ে দেখো।আমি নিজেও দেখছি,বাড়ি থেকেও দেখছে কিন্তু পছন্দ করতে পারছি না।

 সে এবার নানান মেয়ের সিভি ছবি আমাকে পাঠিয়ে মন্তব্য নিতে শুরু করেছে।এই করে করে আমার মন কিছুটা  হলেও নরম করে ফেলেছে।

এর মধ্যে আমার এক পরিচিত তার ডক্টর মেয়ের জন্য ভালো ছেলে খুঁজে দিতে বললেন।মেয়ের ছবি সিভিও দেখলাম। মেয়েটা স্লিম, ফরসা, মেডিকেল স্টুডেন্ট, বয়স কম।ভাবলাম এবার নিশ্চই ভুড়ি, আর বয়সের কথা তুলতে পারবে না শিহাব! গড়িমসি করে পাঠালাম!

কিছুদিন পর :

দোস্তো, মেয়েটাকে কেমন রোগা রোগা লাগে!  কিছুটা 'ভাত দে' ছবির নায়িকার মতো! আবার ডক্টর! সংসারে সময় দিতে পারবে না! আমার বাচ্চা কে পালবে দোস্তো?

 এবার আমি আর রাগ চেপে রাখতে  পারলাম না। বললাম-
: দোস্তো, শুনেছি বাংলা ছবি থেকে  নায়িকা  ময়ুরি রিসেন্ট বিতাড়িত হয়েছে! এখন কম্পলিটলি ফ্রি! আর জানোতো, সে দেখতেও সেরাম লেভেলের! "বিরিয়ানি দে" না হোক, এটলিস্ট 'ভাত দে'র মতো না।তুমি বরং তাকেই প্রপোজ করো।আশাকরি একাই তোমার অগুণিত বাচ্চা পেলে দেবে।চাইলে তাকে দিয়ে "ডে কেয়ারে"র ব্যবসাও করতে পারবে।

শিহাব হাসির ইমো দিল বটে, কিন্তু বুঝেছি আঁতে লেগেছে ওর।

তবু আমতা আমতা করে  লিখলো :
 দোস্তো প্লিজ..... আমায় ভুল বুঝোনা। আর একটু দেখো।

আমিও কেমন যেনো মরিয়া হয়ে গেলাম।যে করেই হোক ওকে মেয়ে পছন্দ করিয়েই ছাড়বো! কিছুদিন পর পাঠালাম এক দারুণ  সুন্দরী মেয়ের ছবি।ডি এস এল আর এ তোলা ঝকঝকে ছবি।আগের অভিজ্ঞতায় এবার আর চেহারা বিষয়ক কোনো রিস্ক নিলাম না।

 মেয়েটি ইডেন কলেজে পড়ছে পলিটিকাল
 সাইন্সে।সেকেন্ড ইয়ার.. ফ্যামিলিও মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত। মনে মনে বললাম এই মেয়েকে বিয়ে করে শিহাব যখন বউ বগলদাবা করে ওর অফিসিয়াল প্রোগ্রামে যাবে সবাই রীতিমতো ওকে ঈর্ষা করবে।আমি কিন্তু আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছি।

শিহাব  ফিরতি ম্যাসেজ পাঠাতে এবার আর সময় নিলো না! একেবারে তড়িৎ জবাব:
: দোস্তো........

পাত্রী চাই (৩)

: দোস্তো.....!
ইয়া আল্লাহ তুমি এ কী দেখাইলা! এতো ভয়ংকর চোখ ঝলসানো টাইপ  সুন্দরী! এরে কই পাইলা দোস্তো! বিস্তারিত শিগ্রী বলো!

: সিভি দিয়েছি সঙ্গে দেখো! যাক তোমার অবশেষে মেয়ে পছন্দ হয়েছে জেনে শান্তি পেলাম!

শিহাব চুপ! কিছু আর লেখে না। ভাবলাম হয়তো মেয়েটির রূপের ছটায় বুদ হয়ে আছে! আমিই তাই আগ বাড়িয়ে আবারো লিখলাম-
:তুমি ভালো করে দেখে বুঝে আমাকে ফাইনাল করো তাহলে।আমি মেয়ে পক্ষকে জানাই।তাদেরোতো তোমাকে দেখার বিষয় আসয় আছে!

শিহাব এবারো কিছু লেখে না।ম্যাসেজ সিন করছে অথচ উত্তর দিচ্ছে না! ভয় পেলাম, ঘটনা আবার উলটে যাবেনাতো! শেষে গণেশ উল্টেই গেলো! এল সেই আকাংখিত ম্যাসেজ-
: দোস্তো রাগ করবা নাতো!( এবার আগেই পটানোর চেষ্টা) মেয়ে অসাধারণ সুন্দরী, নো ডাউট! কিন্তু ইডেনে পড়ে! জানোতো ইডেনের মেয়েরা কেমন হয়! নিজে পাব্লিক ইউনিভারসিটি তে পড়ে শেষে যদি ইডেনের মেয়ে বিয়ে করি কেমন বেমানান লাগবে না দোস্তো!

ওর এই ন্যাকা ন্যাকা আরগুমেন্টে মাথায় আগুন ধরে গেলো! মনে মনে বললাম "হারামজাদা, বজ্জাত! তোর আর বিয়ে করা হইসে! তুই চুল বাল পেকে বুড়া হ! বিয়ে তোর কপালে নাই!" মুখে বললাম
: দোস্তো বিয়ে করবানা সেটা পস্ট বলো, শুধু শুধু ইডেনের  দোষ দিচ্ছ কেন! তাছাড়া বুয়েট,  মেডিকেল ডিইউর কোলের মধ্যে সবেধন নীলমনি ইডেন কলেজ! তাদের প্রেম বিয়ে করতে সুপাত্রের অভাব নাই! বাদ দাও!

: দোস্তো...  ডি ইউ না হোক অন্তত একটা পাব্লিক ইউনিভার্সিটির মেয়ে দেখো! প্লিজ!

এরপরো আমি তাকে মিনিমাম সাত আট টি পাত্রীর ছবি দেখিয়েছি অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে!( আগেই  কিন্তু আপনাদের বলেছি ঘটকালীতে আমার পরম আগ্রহ) বলাবাহুল্য শিহাবের চোখে তাহারা সবাই ভালো মেয়ে কিন্তু...... কেউ নাক উঁচু,  কেউ বেশি লম্বা, হাইট মিলবে না, কারো গায়ের রঙ আরেকটু ব্রাইট হলে হতো, শিহাব কালো, বউ কালো, বাচ্চা কালো হবে... নানান কথা, নানান আবদার!

আমি শেষে কাহিল হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছি! নিজেও কিছু ব্যক্তিগত ঝামেলায় ছিলাম।

যাইহোক এভাবে মাস তিনেক কেটে গেলো! হটাত একদিন এফ বিতে শিহাবের পোস্টের নোটিফিকেশান আসলো " গট ম্যারিড, প্লিজ প্রে ফর আস!"

বউয়ের সঙ্গে হাসি হাসি মুখে একটা ছবিও দিয়েছে! ভাবলাম, মিচকা শয়তান! আমারে এত খাটাইলি, এত তেল মেখে মেখে দোস্তো ডাকলি অথচ বিয়ের কথা একটু  জানাইলিও না!
মনটা ভারী খারাপ হল বিয়েতে সেজেগুজে বিরিয়ানি-বোরহানি-পান খেতে পারলাম না ভেবে, শেষে মানুষের চিরাচরিত স্বার্থপর স্বভাবকে গালি দিয়া শিহাবের বউয়ের প্রফাইলে ঢুকলাম!  দেখি কেমন বিয়া করছে হালায়!

শিহাব  পোস্ট বউকে ট্যাগ করায় সহজেই পেয়ে গেলাম। আহা সেখানে বিয়ে গায়ে হলুদের ছবির ছড়াছড়ি! বিয়ের ছবিতেতো আটা ময়দার অত্যাচারে অরিজিনাল চেহারা বোঝার উপায় নাই! তাই আগের পোস্ট গুলা ঘাটতে লাগলাম।এক জায়গায় পেয়েও গেলাম। কেমন দেখতে সে বউ?

১. বউ  এর দৈর্ঘ্য  থেকে প্রস্থ বেশি।
২. বউয়ের রঙ বোঝার উপায় নাই, কেননা সে ভাল্লুক লোমশ!
৩. বউয়ের অক্ষিযুগল সানগ্লাসে ঢাকা, দেখার উপায় নাই! কিন্তু নাসিকার ডগা এমন থ্যাবড়ানো, যে দেখে মনে হয় কাচে নাক চেপে তাকিয়ে আছে!

(মানুষের চেহারা আল্লাহর দান।নিন্দিতে নাই! কিন্তু শিহাবের বউয়ের বর্ণনা না দিয়ে পারলাম না)

বউ কিছু রান্নার ছবি পোস্ট করে লিখেছে  "মাম্মির কাছে রান্না শিখছি! বন্ধুরা ভাল ভাল রান্নার ইউটিউব লিংক দাও প্লিজ! সামনে আমার....হি হি..."
উপরে আবার লেখা ফিলিং বোরিং!

চট করে বুঝলাম মেয়ের রান্নায় মতি নাই, বাধ্য হয়ে কিছু শিখছে!
এরপর আংগুল উপরে ঘুরিয়ে দেখলাম
স্টাডিড এট ইয়াও মিয়াও খাও নামক অখ্যাত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি!  তা আবার ফ্যাশন ডিজাইং!

রাগে দু:ক্ষে আমার মাথায় এবার নাগাসাকির পরমানু বিস্ফোরণ ঘটলো! ভাবলাম এই ঝাঝ কিছু শিহাবকে দেই! দ্রুত ইনবক্স করলাম ওকে:

: শিহাব!( কোনো দোস্তো মোস্তো নাই! সরাসরি শিহাব) বিয়ে করেছো  দেখলাম।একবার জানালেও না! তবে কথা হলো গিয়ে এই যদি হয় তোমার চয়েজ তবে আমায় এত ঘোরালে কেন?  কী ভাব নিজেকে? ছিলেতো ক্যাবলাকান্ত মিনমিনে।এখন বিসিএস হয়ে ধরাকে সড়া জ্ঞান করছো!

পর পর কতগুলো রাগের ইমোও দিলাম। আত্মা শান্তি পেল। ভেবেছি শিহাব আর উত্তর দেবে না।ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে! কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে উত্তর দিলো-
: দোস্তো!  রাগিও না! আসলে তড়িঘড়ি করে বিয়েটা হয়েছে,  তাই তোমায় বলতে পারি নি। আসলে আমার শশুরের  অমুক মন্ত্রীর সঙ্গে অফিসিয়াল সফর ছিল এ মাসের শেষে।উনি চেয়েছেন বাইরে যাবার আগে বিয়েটা সমাধা করতে।

ওরে বাপরে!  অমুক মন্ত্রীর সঙ্গে সফর! তাহলেতো শিহাবের শশুর কেউকেটা গোছের কেউ! আবারো প্রফাইল ঘাটলাম মেয়ের। উদ্দেশ্য বাবার পরিচয় জানা।
পেলাম। শিহাবের সশুর সরকারের একটা বড় মন্ত্রণালয়ের  উচ্চপদস্থ ! টিভিতেও দেখা যায় মাঝে সাজে টক শো গুলোতে! দেখেই চিনেছি।

ভাবলাম এই ব্যাটার কী জামাইয়ের অভাব পরেছে! শিহাবের মত ক্যাবলাকান্ত দিনমজুরের ছেলেকে  কেনো জামাই করলো!

ঘটনা মাথায় ঢুকালো আমার ঘরের জন। বল্লো
: আহা বুঝলানা! ঘুষের টাকার প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে কন্যা দেহে চর্বির পরিমাণো বাড় বাড়ন্ত! এই আটার দলাকে বিয়ে করবে কে! শেষে শিহাবকে  গরীব পেয়ে গছিয়েছে! হা হা।
 শুনেছি, আমাদের   ট্রেনিং এর সময় সারদায়  এমন অফার পেয়েছে কেউ কেউ!

ইয়া আল্লাহ! তাইতো!  শিহাবকে আবারো ইনবক্স করলাম:

:দোস্তো( এবার মায়া লাগলো, তাই দোস্তো বললাম)
একটু ভুড়িতে তুমি ইউনিভার্সিটি টিচার নাকচ করে দিলে! তাহলে সরবাঙ্গ ভুড়িওয়ালিকে জড়ালে কেনো! করুণা হচ্ছে কিন্তু!

: দোস্তো! এভাবে বলো না মানুষের চেহারা নিয়ে।( ও এতদিন কিন্তু সেটাই করেছে) ওর বাবা উচ্চপদস্থ ।জবের ক্ষেত্রে ভাল ব্যাকাপ পাবো।তাছাড়া সামাজিক মর্যাদারও দরকার আছে।আমাদের পরিবারের অবস্থাতো জানো! বলার মতো না।

একসময় যে নিজের বাবা মা ভাইবোনের কথা ভেবে বউ খুজেছে, সে আজ নিজের পরিবার নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে!

পরিবারের কথা তোলায় শিহাবের বাবা মায়ের কথা মনে হলো। ভাবলাম দেখিতো শিহাবের দিন মজুর বাবা  বিয়েতে  উউচ্চপদাধিকারী  বেয়াইয়ের সঙ্গে কেমন মানিয়েছে!

আবারো বউয়ের প্রফাইল ভরসা! পেলাম দুটি ছবি।

পাত্রী চাই (এই শেষ!)
#গল্প

শিহাবের বউ বিয়ে গায়েহলুদ মিলিয়ে প্রায় শতাধিক ছবি পোস্ট করেছে নিজের এফ বি ওয়ালে।ঝকঝকে তকতকে সব ছবি।হয়তো কোনো বিখ্যাত ওয়েডিং ফটোগ্রাফার দিয়ে এসব ছবি তুলিয়েছে।

অনেক ছবি....
বান্ধবীদের সাথে হাহা হিহির ছবি।
ডিজাইন আয়নার মধ্যে হাসি হাসি মুখের ছবি।
বাবার হাইপ্রোফাইল মেহমান কলিগদের সাথে সুসজ্জিত সোফায় বসা ছবি।
বিয়েতে উপস্থিত নামকরা সেলিব্রেটিদের সাথে ছবি।
বরের  হাত বউয়ের কোমরে,বউয়ের হাত বরের গলায়  ছবি।
সবশেষে শিহাবের কোলে চড়ে হাসিতে ভে ঙ্গে পরা ছবি!
আমার কাছে শেষের ছবিটা সবথেকে উপভোগ্য লাগলো।
বিয়ের ভারি বেনারসি আর ধাতু পাথরের ভারি গয়নাসমেত মিনিমাম তিন মুনি বউকে কোলে তুলতে গিয়ে  একমুনি শিহাবের মেরুদন্ডের হাড় বেকে উপুর হয়ে পরার জোগাড়! আর মুখের ভঙ্গিও দেখতে হয়েছে সেরাম!
মনে হচ্ছে ফটোগ্রাফার ওকে কাতুকুতু দিয়ে হাসতে বাধ্য করেছে!

নাহ! কিন্তু এত এত ছবির ভীড়ে শিহাবের বাড়ির লোকের ছবি পেলাম না।একটা ছবিতে কেবল শিহাবের ছোট বোনটাকে দেখতে পেলাম।নতুন ভাবীর পাশে বসে হয়তো ছবি তুলতে চাইছিল ব্যাচারি। কিন্তু বড়লোক ভাবীর বান্ধবীদের দাপটে ব্যাচারীর আর সোফায় বসে ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি।শিহাবের পাশের সোফার হাতলের চিপায় কোনোমতে ঠেসেঠুসে দাঁড়িয়ে আছে।

(হয়তো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে একটু ভাল দেখানোর লোভে লোকাল কোনো পারলারে অল্পপয়সায় সেজে এসেছে।কিন্তু এখানকার পারসোনা লুকের ভীড়ে ওকে লাগছে আনকোড়া)

বুঝলাম ভবিষ্যতে ক্যারিয়ার সচেতন ভাইয়ের সংসারের এককোনে এভাবেই অপাংতেও হয়ে দাঁড়াতে হবে ওকে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো আমার!

আহা আদরের ছোট বোন!

শিহাব যখন হলে ফাস্ট ইয়ারে সিট না পেয়ে গণরুমে ছাড়পোকার কামড় খেয়ে মানবেতর জীবন পার করতো, তখন সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে স্কুল পড়ুয়া এই আদরের বোনটিই চিঠি লিখে ওকে উৎসাহ দিতো। ওর স্বপ্নগুলোকে পথহারা হতে দিত না।শিহাব নিজে একদিন আমাকে  একটি চিঠি পড়িয়ে কেঁদেছিলো মমতায়।আর আজ.....

আমি মরিয়া হয়ে ওর বাবা মাকে খুঁজতে লাগলাম।
নেই।
নেই।
নেই।
অবশেষে পেলাম তাদের।শিহাবের ওয়ালে কিংবা বউয়ের ওয়ালে নিজেদের পোস্ট করা ছবিতে নয়! শিহাবের কোনো কলিগের পোস্ট শিহাবকে ট্যাগকরা ছবিতে।কী ছিলো সেখানে?

মাত্র পঞ্চাশ পেরোনো সাদা পাঞ্জাবীর এক বৃদ্ধ ছিলো। গায়ে তার বিয়েভোজে রান্নাকরা রেজালার ঝোল পড়েছে।কাটাচামচ দিয়ে সুসজ্ঝিত চেয়ারে বসে খাবার অভ্যাস নেই কি না!

আর ছিলো গালে পানেররঙ লেগে থাকা নতুন
কড়কড়ে মারের তাতের শারি পরা মাথায় ঠিকমতো কাপড় সামলাতে না পারা চল্লিশোর্ধ বৃদ্ধ নারী।

স্বামীর পাঞ্জাবীতে লেগে থাকা ঝোলের দাগ তড়িঘরি করে মুছে দিতে গিয়ে মাথার কাপড়টিই পরে গেছে তার!

  ব্যায়বহুল আলোঝলমল কমিউনিটি সেন্টারে হাজারো লোকের সামনে চলে আসায় খুব লজ্জা আর সংকোচ এদের চোখে মুখে!
মনে হচ্ছে যেনো এদের ঘরে এমন সুপাত্র বি সি এস ক্যাডার জন্ম নিয়েছে দেখে এদের লজ্জার শেষ নেই!
আহা কেন জন্ম দিলাম!
আমরাতো গরীব!
এখন ওর শশুরকে কী জবাব দেই!

 পঞ্চাশোর্ধ শাহরুখ ষোড়শী নায়িকার কোমড় ধরে 'চমক চালো' গাইতে পারে।
কিন্তু জানি, শিহাবের পিতা অল্পবয়সেই হালের গরু ধরে চষে গেছে খেত, আর রুগ্ন গরুটাকে বলে গেছে 'জোরসে চলো'! চুলে পাঁকতো আর এমনিতে ধরেনি!

এঞ্জেলিনা জোলি চল্লিশেও ডজনখানেক বাচ্চা পেলে পুশে ফিট!
শিহাবের আম্মা তিন বাচ্চা পেলেই কুড়িতে বুড়ি! কেননা,কেবল বাচ্চা পালে নি ব্যাচারি।হাস পেলেছে, মুরগী পেলেছে।ছাগল পেলেছে।
আর সেই ডিম দুধ বেঁচা টাকায় শিহাব পেয়েছে শখের জিন্স, নয়তো শখের হাতঘরি!

দেখলাম, বুঝলাম, দীর্ঘ :শ্বাস ফেললাম।

এদিকে দেখি মস্ত ঝামেলা হয়ে গেছে।
শিহাবের  উচ্চপদস্থ  শশুরকে ধরেছে দুদক।অভিযোগ, আয়ের সাথে সম্পত্তির কোনো সামঞ্জস্য নেই! এটিএন না কী যেনো চ্যানেলের কোন নিউজ রিপোর্টার মেয়ে তাকে টোপ ফেলে ঘুষ নেয়া অবস্থায় হাতে নাতে ধরেছ।
শিহাবের শশুরকে ক্যেচকি মেরে পিছে হাত বেধে দুদুকের লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে
.. এই দৃশ্য সব কটা বড় বড় চ্যনেলে সম্প্রচার করছে দিন রাত! বড় মন্ত্রনালয়ের বড় অফিসার, বড় সম্প্রচার!
হা হা।আমি রিমোট ঘুরিয়ে সবগুলো চ্যানেল দেখছি, আর হি হি করে হেসে আরাম পাচ্ছি।

এমন সময় এল শিহাবের ফোন!
:দোস্তো....
ফেঁসেগেছিরে! এবার আমার কী হবে।
মনে মনে বললাম মর তুই! কচু খা! শালা "তাতী নস্টের লোভী"! মুখে বললাম
: দোস্তো কিছু হবে না! মন্ত্রী তাকে হেল্প করবে নিশ্চই।এতদিন একসাথে কাজ করেছে বলে কথা!
: দোস্তো..... নারে, না! মন্ত্রীযে এখন শশুরকে জামাতি বানিয়ে সব দোষ মুছে ফেলছে নিজের!
: হায় হায় কী বলিস!
: দোস্তো, আচ্ছা, এখনতো ঘুষখোর শশুরের কারনে আমাকেও সাস্পেন্ড করতে পারে সাময়িক!  কী বলিস? আবার জামাতের রং দিয়েছে গায়ে!
 হে আল্লাহ! একটু খেয়ে দেয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে খোঁজ খবর যে নিবো তারো উপায় নাই।বউকে বললাম দ্রুত ভাত ভাজি ভরতা কিছু একটা করো.... বলে কিনা: আমিকি এসব করেছি কখোনো? পারলে নিজে রেঁধে খাও!
আচ্ছা যাও, ইউটিউব দেখে পরে শিখে নেবো!

হায়,হায় এখন দেখছি শিহাব আমার বাসায় পান্তা খেতে চলে এসেছে! বউ খেতে দেয় নি।আমি শিহাবের কথা শুনে হেসেই কুটি কুটি হচ্ছি। শিহাব দোস্ত, দোস্তো করে চিৎকার করে যাচ্ছে..... আমি কিছুই শুনছিনা।
শেষে না পেরে আমার গা ধরে ঠেলছে।তখন আমি হাসি থামিয়ে এমন ধমক দিলাম:
বজ্জাত, মিনিমিনে ব্যাটা! এত সাহস! আমার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলিস!

ঘরের মানুষ, ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে উঠিয়েই ফেললো ঘুম থেকে।
: কী মুশকিল! বউয়ের গায়ে হাত দিতে সাহস লাগবে নাকি এতদিন পর! কী হাবি জাবি বল ঘুমের মধ্যে! সারারাত ইন্টারনেট ঘাটলে এমনি হয়! নাও ওঠো শিগ্রী।আজ না তোমার সাড়ে আটটায় ক্লাস!

ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে চোখ আটকে গেল 'প্রথম আলোর' লিড পাতায়।শিহাবের শশুরের ছবি ছেপেছে।হাসি হাসি মুখ।বিদেশে কাদের সাথে যেনো কী চুক্তিতে সাক্ষর করছে।

ক্লাসে যেতে মনে মনে ভাবলাম নাহ! এবারের স্বপ্ন টা আমি ঠিক ঠাক দেখেছি।জানি নিশ্চিত সত্যি হবে একদিন।

(সমাপ্ত)

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালশ
(ফসবুক থেকে সংগৃহিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন