পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৮

ধর্ষণ বৃদ্ধি রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থার করাপশনের ফলাফল

ড. ফারজানা মাহবুবা
(ফেসবুক পোস্ট থেকে)
আসিফা'র কথা সব জায়গাতেই দেখছি।
ইন্ডিয়া নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে যে 'মুসলিম' বাচ্চা মেয়েটাকে মন্দিরের ভিতরে আটকে রেখে কয়েকজন 'হিন্দু' গ্যাং রেইপ করে কয়েকদিন পর শেষে গলা চিপে আর মাথায় পাথর দিয়ে থেঁতলে দিয়ে
মেরেই ফেলেছে বাচ্চাটাকে। 

কিন্তু পূজা'র কথা জানেন?
বাংলাদেশে যে 'হিন্দু' বাচ্চা মেয়েটাকে 'মুসলিম' সাইফুল নামের এক লোক রেইপ করার সুবিধার জন্য ব্লেড দিয়ে কেটে বড় করে নিয়েছে বাচ্চাটার প্রাইভেট পার্ট,
রেইপ করার সময় গলা চেপে ধরায় যার ব্রেইনে অক্সিজেন চলাচল বন্ধ থাকায় যে অজ্ঞান হয়ে যায়,
পুরো ঘটনা এতটাই বিভৎষ,
পুজা'কে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তার Dr. Sonia Zemin এর নিজের ফেইসবুকে লেখা ফার্ষ্ট হ্যান্ড বর্ণনা পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে আমার রীতিমত সিক ফীল হচ্ছিলো।

আমি 'মুসলিম' আর 'হিন্দু' শব্দ দু'টো ইনভার্টেড কমা'র ভিতর দিয়েছি।
কারন আছে।
বলছি।

সোশাল মিডিয়াতে কিছুদিন আগেই দেখছিলাম
ধর্ষন আর মেয়েদের কাপড় নিয়ে তুমুল ঝড়।
মোশাররফ করিম কী যেন বলেছিলো কোথায়।
তার ইন্টারপ্রিটেশান, মিসইন্টারপ্রিটেশান এইসবের উপর বেইস করে সেই ঝড়ের শুরু।

এখন দেখছি আসিফা'র কথা যারা শেয়ার করছে তাদের মধ্যে একটা প্রবনতা খুব প্রবল।
ধর্ষন যারা করেছে তারা 'হিন্দু' 
ধর্ষন যারা করেছে তারা 'মন্দিরে' আটকে রেখে ধর্ষন করেছে
ওরা "রামের ইন্ডিয়া" বানাতে চায়-
এসব কমেন্টের টার্গেট কালপ্রিট একটাই-
ধর্ম।
যেন ধর্মীয় বিদ্বেষই আসিফা'র এমন মৃত্যুর মেইন কারন।

এক একটা বাচ্চা মেয়ে এভাবে বিভৎষ অত্যাচারে রেইপ হতে হতে মরছে
আর দেখছি,
দেখছি কীভাবে সবাই হয় ধর্ম নাহয় মেয়েদের কাপড় চোপড় নিয়ে টানাটানি করছে!
এ দু'টোই যেন মেইন কালপ্রিট।

আচ্ছা,
এই দুই-ই যদি কালপ্রিট হয়,
পূজা আর আসিফা
দুইজনই এতো বাচ্চা মেয়ে!
যাদের শরীর উদোম করে রাখলেও একটা বাচ্চা ছাড়া কিছু মনে হবে না,
যাদের বুকের শেইপে এখনো বাচ্চার শরীর ছেড়ে মেয়েত্ব'র ভাবের ছিটেফোঁটাও আসেনি!
যদিও তারা উদোম থাকা দূরের কথা,
দুইজনেরই রেইপ পরবর্তী ছবি যেখানে যেখানে পেয়েছি খুঁজে বের করে ভাল করে দেখেছি
দুইজনেরই নরমাল, বলতে গেলে পুরো শরীর ঢাকা ফ্রকের মত কাপড় চোপড় পড়া ছিলো।


আর ধর্ম? 
আসিফাকে যদি মুসলিম বলেই ধর্ষন করে মেরে ফেলা হয়,
তাহলে পুজাকেও কি হিন্দু বলেই এভাবে ব্লেড দিয়ে প্রাইভেট পার্ট কেটে গলা চিপে ধরে রেইপ করা হয়েছিলো? 

না,
জ্বী না,
আমি একবারের জন্যও বলছিনা মেয়েদের ধর্ষনে
মেয়েদের গায়ের কাপড় চোপড় বা ধর্মীয় বিদ্বেষ কোনো রোল প্লে করে না।
আমি একবারের জন্যও তা বলছি না।
কিন্তু এগুলোকেই "একমাত্র" বা "মেইন" কারন বলতে আমি নারাজ।

এসব বিতর্কে যে সমস্যা তা হলো,
সবাই কেমন যেন প্রান্তিক চিন্তা করে।
যেন "একমাত্র" ধর্মই এখানে সমস্যা।
অথবা যেন "একমাত্র" মেয়েদের কাপড় চোপড়ই এখানে সমস্যা।

এই "একমাত্র" টাইপের চিন্তা যারা করেন,
সিরিয়াসলি,
আপনাদের ব্রেইনের চিন্তাভাবনার লেবেল গরুর চিন্তাভাবনার লেবেলেরও নীচে।
আপনারা দয়া করে গরুর মত ঘাস খান।
ঘাস খেয়ে খেয়ে জাবর কাটেন।
আর আপনার যদি নিজের কোনো ছোট বাচ্চা মেয়ে থাকে,
জাবর কেটে ঐ মেয়েকে রক্ষা করার চেষ্টাই করেন।
কারন আপনাদের এসব প্রান্তিক চিন্তাভাবনায় এসব সমস্যার সমাধান হবে না।
যেহারে ধর্ষন ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে,
আপনার বাচ্চা মেয়েটাও যে কোনো মুহুর্তে পূজা বা আসিফা হয়ে যেতে পারে।
তাই আর কাউকে পারেন না পারেন
নিজের মেয়েটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন।

আর যারা নিজের বাচ্চা'র সাথে সাথে আর দশটা বাচ্চা মেয়েকেও বাঁচাতে চান,
একটু বার্ডস আই ভিউ দিয়ে দেখুন।
সমস্যার লেবেলে দাঁড়িয়ে এক চোখাভাবে না দেখে
উপর থেকে পুরো স্ট্রাকচারকে দেখতে চেষ্টা করুন।

আপনার বাচ্চা মেয়েটার ধর্ষিতা হয়ে খুন হওয়ার হার বাড়ছে নাকি কমছে
তা আপনার বাচ্চা মেয়েটা হিন্দু নাকি মুসলিম
বা আপনার বাচ্চা মেয়েটা বোরকা পড়ে আছে নাকি বিকিনি পড়ে আছে
তার উপর যদি এক পার্সেন্টও নির্ভর করে
বাকী নিরানব্বই পার্সেন্ট নির্ভর করছে
দেশের পলিটিক্সের উপর। 
জ্বী,
স্বীকার করতে চান বা না চান,
দেশের রাজনীতি যত নীচে যাচ্ছে
আপনার বাচ্চা মেয়েটার ধর্ষিতা হয়ে খুন হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়ছে।

এই হিসাব বুঝতে আপনাকে সমাজ বিজ্ঞানী বা ঝানু রাজনীতিবিদ হওয়া লাগবে না।
স্রেফ এতটুকু তো বুঝেন যে
একটা সমাজের আইন যত ঢিলা হবে
ঐ সমাজের অপরাধের হার তত বাড়বে,
এতটুকু তো বুঝেন?

এক সময়,
গ্লোবালাইজেশানের আগে,
আপনার আমার মত মানুষদের জীবনের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো ছিলো ট্রাইবাল।
(মানুষের স্রেফ ব্যক্তিগত বলে কখনোই কিছু ছিলো না। এখনো নেই। বেকুবের মত নিজের "ব্যক্তিগত" বলে যা ভাবেন, তার কিছুই আপনার ব্যক্তিগত না। সে কথা না হয় আরেকদিন হবে।)
কিন্তু এখন,
গ্লোবালাইজেশানের পরে,
এখনকার সোশাল স্ট্রাকচার এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে,
আপনার আমার আমাদের সমস্ত ব্যক্তিগত সমস্যা সম্ভাবনা আশংকা উদ্বেগ
সবকিছুই এখন পলিটিক্যাল।

তাই আপনি যতই বলেন
আমি সাধারন পাবলিক, পলিটিক্সে আমার ইন্টারেষ্ট নাই,
ওয়েল,
আপনার ইন্টারেষ্টের ক্যাথা পুড়ে আপনার সমস্ত কিছু ঐ পলিটিক্সের উপরেই নির্ভর করছে।

আপনি চাকরি পাবেন কি পাবেন না
বা আপনার ব্যবসা করার মত স্ট্রাকচার আপনার আশেপাশে আছে কি নাই
আপনার বাচ্চাটা স্কুলে সেইফলি পৌছাবে কি পৌঁছাবে না
আপনি যা খাচ্ছেন
তার মধ্যে কতটূকু বিষ খাচ্ছেন
আপনার এত দাম দিয়ে কেনা গায়ের কাপড়টা দুই দিনেই ত্যানার মত ছিঁড়ে যাবে , নাকি টেকসই হবে,
সব
স-ব-ব
সব ডিপেন্ড করে দেশের পলিটিক্স কতটা তলানীতে নামছে তার উপর।

সব তো আর আপনাকে বুঝিয়ে গিলিয়ে খাইয়ে দিতে পারবো না,
আপনার বাচ্চা মেয়েটার ধর্ষিতা হওয়ার সম্ভাবনার হার বাড়া কমার সাথে পলিটিক্সের রিলেশানশীপের কথাটাই বুঝিয়ে বলি।

তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
আসিফা রেইপড হয়ে মরেছে ইন্ডিয়া নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে।
পুজা রেইপড হয়ে মরার মতই পড়ে আছে বাংলাদেশে।
পূজা আর আসিফা'র দু'জনের বয়সের মাঝামাঝি বয়সের আমার মেয়েটা থাকে সিডনীতে।

ধর্ম আর কাপড় যদি মেইন কারন হতো,
তাহলে আমার মেয়েটার এমন ভিক্টিভ হওয়ার সম্ভাবনা পুজা আর আসিফা'র চেয়ে একশগুন বেশী হওয়ার কথা।
কারন আমরা এমন জায়গায় থাকি,
এমন শহরে থাকি,
যে শহরে এমন ধর্ম নাই যার অনুসারীরা নাই!
এমন চামড়ার কালারের মানুষ নাই যারা থাকে না!
আমার বাসা থেকে ঠিক তিন মিনিট ড্রাইভিং দুরত্বে মসজিদ যেমন আছে,
ঠিক দেড় মিনিট ড্রাইভিং দূরত্বে বিশাল হিন্দুদের মন্দিরও আছে!

আর কাপড় চোপড়?!
প্রায় সময় মেয়েদের কাপড়চোপড়ের অবস্থা দেখে আমার নিজের চোখ সামলানো দায় হয়ে যায়।
আমি এমেরিকা ঘুরে এসে অনেককেই বলেছি,
এমেরিকা আর অষ্ট্রেলিয়ার মধ্যে তুলনায় এমেরিকা আমার কাছে সবকিছুতে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে সেকেন্ড প্লেইসে মনে হয়েছে,
শুধু একটা বিষয় ছাড়া।
তা হলো এমেরিকার সাধারন মেয়েদের কাপড় চোপড় অষ্ট্রেলিয়ার সাধারন মেয়েদের কাপড় চোপড়ের চেয়ে অনেক অনেক অনেক ভদ্র মনে হয়েছে আমার কাছে।
(নেভার জাজ এমেরিকা ফ্রম হলিউড মুভিজ অর মিডিয়া! এরচে' ভুল আর কিছু হবে না!)

আমি এ পর্যন্ত যে কয়টা দেশ ঘুরেছি,
(খুবই সামান্য কিছু দেশ যদিও)
অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা সবচে' ছোট,
সবচে' অশ্লীল কাপড় চোপড় পড়ে।
এতই অশ্লীল যে ওদের টাইট প্যান্টের ভিতর দিয়ে ওদের প্রাইভেট পার্টের ভাঁজ পর্যন্ত বুঝা যায়। 
রাস্তা ঘাটে খুব কমন ড্রেসাপ এটা।
খুবই কমন।

আমার প্রশ্ন,
তাহলে ইন্ডীয়া আর বাংলাদেশের বদলে
অষ্ট্রেলিয়ার সিডনীই তো হওয়া উচিত ছিলো ধর্ষনের রাজধানী না শুধু, এখানে তো প্রতিটা বাচ্চা মেয়ে ধর্ষিতা হওয়ার কথা ছিলো!!!
তা না কেনো?

(হয়না, তা না।
যা হয়, তা গুনতি হিসেবে তুলনা করলে পার্সেন্টেজের মধ্যেই আসবে না।)

উত্তর দিন।
কেনো তা না?

কারন একটাই।
এখানকার পলিটিক্স।
এখানকার সরকার।
এখানকার বিচার ব্যবস্থা।

আজকে অস্ট্রেলিয়ার পলিটিক্স বাংলাদেশের মত পঁচে যাক,
পুলিশের মধ্যে দূর্নীতি ঢুকে যাক,
বিচার ব্যবস্থায় দূর্নীতি ঢুকে যাক,
কালকেই হাজারে হাজারে আসিফা আর পূজা তৈরী হয়ে যাবে সিডনীর অলিতে গলিতে।

পলিটিক্যাল করাপশান জিনিষটা এমন,
তসবিহ'র দানার মত।
তসবিহ ছিঁড়ে একটা দানা পড়ে গেলে
বাকী দানাগুলোও একের পর এক পড়ে যায়।
পুরো তসবিহ ছিঁড়ে দানাগুলো সব ছড়িয়ে যায়।
পলিটিক্যাল করাপশনও তেমন।
বিদ্যুতের গতিতে সমাজের একটা পার্ট থেকে আরেকটা পার্টকে ইলেক্ট্রিকিউট করে।

গতকাল আপনি পলিটিক্স নিয়ে মাথা ঘামাননি,
আপনার গ্রামেই লীগের ছেলেরা গিয়ে অপজিশন পার্টির নেতার বউকে দিনের আলোতে তার নিজের ঘরেই শুধু ধর্ষনই করেনি
বউটার বুক কেটে নিয়েছে
আপনি পত্রিকায় খবরটা পড়ে নির্লিপ্তভাবে পাতা উল্টিয়ে গিয়েছেন
কিন্তু ঐ যে একটা অপরাধের শাস্তি দেয়নি সরকার
নিজের লোক বলে
এমন পলিটিক্যাল গুন্ডামী আর বদমাইশী ছড়াতে ছড়াতে অলিতে গলিতে ছড়িয়েছে
আপনার পাশের বাসার শিবির বা বিএনপির ছেলেটাকে তার কলেজের গেইটের সামনে গুলি করে মেরে ফেলেছে লীগের ছেলেরা,
আপনি পাত্তাই দেননি টোটালি
এভাবেই ঐ আসিফার ধর্ষনকারী আর পুজার ধর্ষনকারীদের মত অ-মানুষেরা বুঝে গিয়েছে
গুন্ডামী নষ্টামী আর বদমাইশি'র শাস্তিও কীভাবে পলিটিক্যাল গলি ঘুপচি ইউজ করে এড়ানো যায়,

শুধু তাইই না,
একবার যখন রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে কাজ করা মানুষেরা করাপশানে জড়ায়,
তা পলিটিক্যাল হোক না কেনো
তারা বাকী করাপশানগুলোতেও জড়ায়,
যেখানে টাকা বা অন্য যে কোনো স্বার্থ খুঁজে পায়
সেখানেই তারা রাষ্ট্রের নাগরিকের চেয়ে নিজের জন্য টাকা বা স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করে।

তাই আপনি যখন (আল্লাহ মাফ করুন) পুজা বা আসিফার বাবা বা মা হবেন,
থানায় যাবেন বিচার চাইতে
একমাত্র তখনই বুঝবেন
হ্যা, একমাত্র তখনই বুঝবেন কী ভয়াবহ কাজ করেছেন এতদিন পলিটিক্সের প্রতি চোখ বন্ধ করে থেকে!
আপনার চোখের সামনে রাষ্ট্রের প্রতিটা কাঠামোতে কাজ করা মানুষগুলো নষ্ট হয়েছে।
আপনি কোনো প্রতিবাদ করেননি।
কারন পলিটিক্সে আপনার ইন্টারেষ্ট নেই।
কিন্তু এখন যখন আপনার সন্তানই আসিফা বা পূজা
এখন আপনি মাথা দেয়ালে ঠুকছেন!
ঠুকতে ঠুকতে মাথা ফাটিয়ে ফেলে মরে যান
তাও দুই পয়সার জাষ্টিস পাবেন না কোথাও।

বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায় অলরেডী লেখালেখি শুরু হয়ে গিয়েছে,
বিষয়- ধর্ষনের রাজধানী এখন ইন্ডীয়াতে নাকি বাংলাদেশে,
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর খুব শখ দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক নাম্বার পুরুষ্কার এনে দেয়ার।
ভালই,
ভালই,
খুবই ভাল!
আমরা মেয়েদের ধর্ষিতা হওয়ার রেইটের ক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রথম পুরুষ্কার পেতে যাচ্ছি অচিরেই!
ব্রাভো!
চিয়ার্স!
হিপ হিপ হুররে!!

লেখক: জেন্ডার এন্ড উইমেন স্পেশালিস্ট, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন